গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন দেশের দায়িত্ব নেয়, তখন অনেকেই আশা করেছিলেন একটি স্থিতিশীল ও সমন্বিত শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠবে। কিন্তু মাত্র সাড়ে নয় মাস পর সেই আশার জায়গায় দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গভীর মতবিরোধ।
এই সরকারের ভিত্তি ছিল সশস্ত্র বাহিনী, ২০২৪ সালের গণ-আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতারা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আস্থা ও সমর্থন। সাধারণ জনগণেরও সমর্থন ছিল, যারা কোনো পদ-প্রতিষ্ঠার আশা না করে শুধু একটি ভালো শাসনব্যবস্থা চেয়েছিলেন।
শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ছিল পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও পরামর্শের সম্পর্ক। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়ার চেষ্টা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সম্পর্ক ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে।
সর্বশেষ সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়, সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেও এখন ফাটল দেখা দিয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, সশস্ত্র বাহিনীর সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের অন্ধকারে রেখে।
এই সংকটময় পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। কয়েকজন উপদেষ্টার 'রাজনীতিবিরোধী' অবস্থান এবং প্রধান উপদেষ্টার কিছু মন্তব্য গত ১৫ বছরে নিপীড়নের শিকার হওয়া রাজনীতিকদের মনোক্ষুণ্ণ করেছে।
সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করেই—যেমন, মিয়ানমারে মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য ‘হিউম্যানিটারিয়ান চ্যানেল’ চালু করা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের একটি টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া। পাশাপাশি, সরকারের একজন মুখপাত্রের মন্তব্য অনেক রাজনীতিবিদের কাছে অপমানজনক বলেও মনে হয়েছে।
বিএনপির একাধিক নেতা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে ইশরাক হোসেনের মেয়র হিসেবে শপথ নিতে না পারার বিষয়টি সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণেরই একটি দৃষ্টান্ত। যেখানে নির্বাচন কমিশন তাঁকে বৈধ ঘোষণা করেছে, সেখানে একটি রিটের অজুহাতে শপথগ্রহণ আটকে দেওয়া রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত বলে মনে করেন তাঁরা।
সব মিলিয়ে, দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে—প্রধান উপদেষ্টার অবস্থান ও কার্যকলাপ কি এই অস্থিরতার জন্য দায়ী? এবং এখন কি সময় এসেছে তাঁর পদত্যাগ নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করার?
সম্প্রতি বিএনপির পক্ষ থেকে একাধিক বিবৃতি ও কর্মসূচিতে প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। দলের নেতারা জানান, ইশরাক হোসেনের শপথগ্রহণ নিয়ে সরকারের আচরণ ছিল পক্ষপাতমূলক এবং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাঁরা দাবি করেন, এই ঘটনার প্রতিবাদে নগর ভবন ও রাজপথজুড়ে চলা সপ্তাহব্যাপী আন্দোলনের কারণে নগরবাসীর ভোগান্তি অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও পরিস্থিতি বাধ্য করেছে তাদের এমন সিদ্ধান্ত নিতে।
তাঁদের অভিযোগ, চার দিন ধরে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়ায় শেষমেশ সংবাদ সম্মেলনের পথ বেছে নিতে হয়। বিএনপির নেতারা মনে করেন, জনদুর্ভোগের দায় সরকারের, কারণ দীর্ঘ ছয় দিন ইশরাক ইস্যু ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, অথচ এনসিপি নেতার মাত্র এক ঘণ্টার আলটিমেটামেই সরকার বৈঠক ডেকে তাদের দাবি মেনে নিয়েছে।
বৃহস্পতিবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির শীর্ষ নেতারা ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তোলেন। একই সঙ্গে সরকারের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি বজায় রাখার স্বার্থে দুই ছাত্র উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার অব্যাহতি চান তারা। তাঁদের বক্তব্য, সময়মতো নির্বাচন না হলে সরকারের প্রতি বিএনপির সমর্থন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
এদিকে, একই দিন কাকরাইলে ইশরাক ইস্যুতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের আন্দোলনের সময় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে। তারা নির্বাচন কমিশনকে বিএনপির ‘আজ্ঞাবহ’ বলে আখ্যা দেয় এবং দাবি করে প্রথমে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিতে হবে। যদিও নির্বাচন কমিশন এখনো কোনো নির্বাচন আয়োজন করেনি কিংবা সীমানা নির্ধারণের কাজও শেষ হয়নি—তাতে এমন মন্তব্য কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এনসিপি সরকারে থাকা তিন উপদেষ্টাকে বিএনপির ঘনিষ্ঠ বলে চিহ্নিত করে তাঁদের পদত্যাগও দাবি করেছে। পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে পড়ে যে, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস প্রকাশ্যে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন।
বৈঠক শেষে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেন। পরে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, "আমি যদি কাজ করতে না পারি, তাহলে কীভাবে চলবে? আমাকে এমন একটি জায়গা থেকে আনা হয়েছিল যেখানে দেশের সংস্কার ও পরিবর্তন সম্ভব হবে। কিন্তু যেভাবে আমাকে চাপ দেওয়া হচ্ছে, তাতে আমি কাজ চালিয়ে যেতে পারছি না।"
এর পরেই এনসিপি নেতা এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তাঁকে পদত্যাগ না করার অনুরোধ জানান।
আমাদের অবস্থান স্পষ্ট: প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ এখন কোনো সমাধান নয়। বরং, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা সংলাপের মাধ্যমে ঘুচিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করাই এখন সরকারের প্রধান দায়িত্ব।
অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ থাকতে হবে। কাউকে কোনো দলের ‘দোসর’ বলে অভিযুক্ত করা যেমন অনুচিত, তেমনি যাঁদের দলীয় রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ আছে, তাঁদের উচিত হবে পদত্যাগ করে সরকারকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা।
নাহিদ ইসলাম পদত্যাগ করে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন এবং বর্তমানে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু সরকারে থেকে কেউ দলীয় রাজনীতি করলে সমস্যা আরও জটিল হবে। এক উপদেষ্টা যদি এক দলকে সমর্থন করেন, অন্যরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই অন্য দলের প্রতি ঝুঁকবেন, যা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য দৃষ্টান্তহীন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।
গণ–অভ্যুত্থানে সক্রিয় রাজনৈতিক দল ও ছাত্রনেতাদের একে অপরের বিরুদ্ধে দোষারোপ ও তিরস্কারের ভাষা ব্যবহার অত্যন্ত হতাশাজনক। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে অশোভন ভাষা ব্যবহৃত হলেও ‘ডাস্টবিন’ বা ‘সান্ডা ও বোতল’ সংস্কৃতি এতটা প্রসারিত হয়নি। তখন রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হলেও মবতন্ত্রের মতো প্রবণতা ছিল না।
দেশে ন্যূনতম গণতন্ত্র বজায় রাখতে হলে মবতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দলীয় কাজে ব্যবহারের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নির্বাচনের বিষয়ে সরকার দ্রুত স্পষ্ট রূপরেখা দিতে বাধ্য—এখানে ‘ডিসেম্বর না জুন’ বিতর্ক নয়। অবিলম্বে সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করলেই অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা অনেকটা কমবে বলে আশা করা যায়।
x
Post a Comment